কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা নিয়ে কিশোরগঞ্জ-৪ নির্বাচনী এলাকা গঠিত। আওয়ামী লীগের দূর্গ বলে খ্যাত এই আসনে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদ এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে তার পুত্র রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক নির্বাচিত হন।
এছাড়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে বিএনপি থেকে প্রকৌশলী ইমদাদুল হক, ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে ফরহাদ আহমেদ কাঞ্চন ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে আবদুল লতিফ ভূঁইয়া সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কিন্তু আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই দূর্গের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। সারা দেশে দলটি প্রকাশ্য রাজনৈতিতে না থাকায় উক্ত আসনে বিএনপি'র দশ জন ও বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামী’র একক প্রার্থীর কথা বেশি শোনা যাচ্ছে।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের সমর্থনে হাওরের এই তিন উপজেলার প্রতিটি গ্রাম ও হাট-বাজারেই চোখে পড়ছে ব্যানার, পোস্টার, ফেষ্টুন ও দেওয়াল লিখন। প্রার্থীরা নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠকের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। চায়ের স্টলে উঠছে তাদের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপি থেকে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন, তাঁরা হলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, সাবেক সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম মোল্লা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ টাস্ট্রের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ছাত্রদল নেতা সুরঞ্জন ঘোষ, ড্যাব নেতা অধ্যাপক ডা. ফেরদৌস আহমেদ লাকী, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম রতন, সাবেক উপ-সচিব জহির উদ্দিন ভূঁইয়া, অষ্টগ্রাম উপজেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক ও তিনবারের নির্বাচিত সদর ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ ফাইয়াজ হাসান বাবু, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মোঃ হাফিজুল্লাহ হিরা, মিঠামইন উপজেলা বিএনপির সভাপতি এড. জাহিদুল আলম জাহাঙ্গীর এবং বুয়েট ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি প্রকৌশলী নেছার উদ্দিন প্রমুখ।
তবে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হওয়ার কারণে, ১৯৮৬ সালে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাংসদ এড. ফজলুর রহমান মনোনয়ন দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে আছেন বলে অনেকেই ধারণা করছেন। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে তার ধর্মীয় রাজনৈতিক বিষয়ে আক্রমণাত্মক বক্তব্যের ও শেখ মুজিব প্রীতির জন্য ধর্মভিত্তিক দল ও সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে। ১৯৮৬ সালের পর ১৯৯১ সনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ১৯৯৬ সালে স্বতন্ত্র, ২০০১ সালে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ২০০৮ ও ২০১৮ সালে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে তিনি পরাজিত হন।
এই বিষয়ে এড. মো. ফজলুর রহমান জানান, বিগত সরকারের আমলে অনেক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছি। '৯৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে জয়লাভ করলেও আমাকে ষড়যন্ত্র করে হারিয়ে দেওয়া হয়। মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমি আমার নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি গ্রাম ঘুরে সকল নেতা-কর্মীসহ সবার সাথে কথা বলেছি। আমার বিশ্বাস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল আমাকে মনোনয়ন দিলে ধানের শীষ প্রতীকে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হব।
বিএনপি অন্যতম মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম মোল্লা বলেন, আমি ১৯৭৯ সালে ছাত্রদল প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মী ছিলাম। পরে কর্মজীবনে বিএনপির শীর্ষনেতাদের এলাকায় ইউএনও ও ডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য, ফ্যাসিষ্ট সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে কোন পদোন্নতি না দিয়ে বাধ্যতামুলক অবসরে পাঠায়। বর্তমান সরকার পদোন্নতি ও পদায়ন করলেও আমি তা গ্রহণ করিনি। নির্বাচনী এলাকায় আমার বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে। দলের প্রতি আমার আনুগত্য ও ত্যাগের কারণে আমিই এবার মনোনয়ন পাব বলে আমি মনে করি। আমি মনোনয়ন পেলে আমার বিশ^াস দলীয় ও ব্যাক্তিগত ইমেজের কারণে ধানের শীষে ভোট দিয়ে হাওরের জনগণ আমাকে বিজয়ী করবে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সুরঞ্জন ঘোষ বলেন, বিগত বিএনপি সরকারের আমলে আমি তিন উপজেলায় ব্যাপক কাজ করেছি, এই আসনে ৫৫ হাজার হিন্দু ভোটার রয়েছে, তাদের কে ধানের শীষে টানতে হলে আমাকে দলীয় মনোনয়ন দিতে হবে। ২০১৮ সালে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়ে পরে প্রত্যাহার করে। এবার মনোনয়ন পেলে আমি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবার আশা রাখি।
তিনবারের নির্বাচিত অষ্টগ্রাম সদর ইউপি চেয়ারম্যান, অষ্টগ্রাম উপজেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক ও বর্তমান জেলা বিএনপির সদস্য সৈয়দ ফাইয়াজ হাসান বাবু বলেন, আমি ১৯৯৫ সালে সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ভাইয়ের হাত ধরে ছাত্রদলের রাজনীতি শুরু করে ছিলাম। আওয়ামী দূর্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে বিএনপির রাজনীতি করে যাচ্ছি। এলাকায় আমার বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে। ২০১৬ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছিলাম কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপে বেলা ১১টা বাজার আগেই আমাকে নির্বাচন বয়কট করতে হয়েছিল। আমাদের রাজনৈতিক অবিভাবক চৌকস রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জননেতা তারেক রহমান আগামী নির্বাচনে যদি তরুণদের প্রাধান্য দেন তবে আমি মনোনয়ন পাবো বলে বিশ্বাস করি।
এদিকে, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও জামায়াতে ইসলামী ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর শাখার আইন বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট শেখ রোকন রেজাকে দলীয় মনোনয়ন দেবার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে।
শেখ রোকন রেজা এ প্রতিনিধিকে জানান, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লাগামহীন নির্যাতন নিপীড়নের মধ্যেও জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সকল স্থরে সৎ ও দক্ষ জনবল সৃষ্টি করেছে। আর এই হাওর এলাকায় সবসময় দুই নেতা কেন্দ্রীক নির্বাচন হতো, কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন হবে। তাই, মানুষ সৎ ও আদর্শিক দল জামায়েতে ইসলামীকে ভোট দিবে। কারণ, সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছে জামায়েতে ইসলামীই পারবে সন্ত্রাসমুক্ত সাম্য ন্যায়ের কল্যাণ মূলক রাষ্ট্র গঠন করতে।
তবে নির্বাচনী মাঠে বিএনপি ও জামাতে ইসলামী ছাড়া অন্য কোন দলের পদচারণা তেমন চোখে পড়ার মতো নয়।